মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ এক আলেম
নিরবে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন কিশোরগঞ্জের কৃতি সন্তান মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল সাহেব হাফিঃ।
এলাকায় পরিচিত পীর হিসেবে। মানুষের সুখ-দুঃখের কথা ভাবেন, শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করেন। যে শিক্ষায় শুধু দুনিয়া নয়, থাকবে পরকালের সম্বল। এ ভাবনা থেকে একে একে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাড়ে ছয় শ’র বেশি মক্তব-মাদ্রাসা। তিনি ভাবেন আলেম-উলামা ও সাধারণ মুসলমানদের নিয়েও।
মুসলমানদের প্রথম পাঠশালা ও কোরআন মাজিদ শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হচ্ছে মক্তব-মাদ্রাসা। শিশুরা নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে এখান থেকে। প্রাচীনকাল থেকে মসজিদকে কেন্দ্র করে চলে আসছে মক্তব শিক্ষার কার্যক্রম। তবে এর বাইরে আলাদা মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
নানাবিধ সীমাবদ্ধতায় ধীরে ধীরে সমাজ থেকে মক্তব শিক্ষা হারিয়ে যেতে বসেছিল। তখন এগিয়ে আসেন এক উম্মাহ দরদি আলেম। প্রতিষ্ঠা করেন অসংখ্য মক্তব-মাদ্রাসা। তিনি মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল। সারাদিন কাটে তার দ্বীনের কাজে দৌড়াদৌড়ি করে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। পাখির মতো ছুটে বেড়ান দেশে-বিদেশে। মানুষ কীভাবে সঠিক দ্বীন পাবে, কীভাবে ইমান-আমল সুন্দর করে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন সুন্দর করবে, সে চিন্তায় সদা ব্যস্ত থাকেন। রাতের ইবাদত ও কান্নায় আছে তার অনন্য নজির। ছাত্রজীবন থেকেই নিয়মত তাহাজ্জুদ আদায়কারী ব্যক্তিত্ব। হজরত আতহার আলী (রহ.) ও হজরত আহমদ আলী খান (রহ.) (জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জের আজীবন মুহতামিম)-এর স্নেহধন্য এই আলেম ছোটবেলা থেকেই নামাজি, পরহেজগার ও নবী কারিম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের কঠোর অনুসারী।
পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে জীবনের সবকিছুতেই নবী জীবনের জীবন্ত নমুনা। বয়ানের মঞ্চে যখন ওঠেন, মানুষকে দ্বীনের কথা বোঝাতে গিয়ে তখন শিশুর মতো ধুক ধুক করে কাঁদেন। মায়াভরা অন্তর নিয়ে দরদমাখা ভাষায় ধর্মের বাণী শোনান। আধ্যাত্মিক রাহবার (পীর) হিসেবে পরিচিত এই আলেম, ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি সময়ে সময়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় অধ্যাপনার কাজ করেন। এ কারণে দেশ-বিদেশে তার অসংখ্য মুরিদ, ভক্ত ও ছাত্রছাত্রী রয়েছে। আমল, আখলাক ও কর্মনিষ্ঠা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। শৈশব থেকেই খুবই নম্র-ভদ্র এক মানুষ। আজও আছেন আলোকিত মানুষ হয়ে।
তার বড় হওয়ার পেছনে রয়েছে বড় বড় মনীষীদের সুদৃষ্টি, ও নেকদোয়া। ওস্তাদ-গুরুজনের খেদমতে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। জীবনে সংশ্রব ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন অনেক বুজুর্গ আলেমের। আরেফ বিল্লাহ হজরত শাহ হাকিম মুহাম্মাদ আখতার (রহ.) ১৪০৪ হিজরিতে তাকে খেলাফত (আধ্যাত্মবাদ প্রচারের বিশেষ দায়িত্ব) প্রদান করেন। সেই থেকে তিনি পীর-মুরিদির কাজও করে যাচ্ছেন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তার সুখ্যাতি ছড়িয়েছে বহির্বিশ্বেও। তাই দ্বীনের তাগাদায় ভক্তদের অনুরোধে প্রতি বছরই তিনি পাড়ি জমান বিদেশের মাটিতে। ভারত, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, আফ্রিকা ও ফ্রান্সের মতো রাষ্ট্রগুলোতে তিনি দ্বীনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই গুণী আলেম ১৩৬১ বাংলা সনের ৩০ মাঘ কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর থানার লাখুহাটি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামাতার বংশে একাধিক আলেম ও পীর-মাশায়েখ ছিলেন। সে হিসেবে তাদের পরিবারকে মানুষ আগে থেকেই সমীহ করত। পিতা সিদ্দিক হোসাইন ও মাতা মেহেরুন্নেসার ২ ছেলে ও ৫ মেয়ের মধ্যে বয়সে তিনি তৃতীয়। তার বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী ও মা ছিলেন পরহেজগার গৃহিণী। বিসমিল্লাহর পাঠ মায়ের কাছেই। দ্বীনের জরুরি জ্ঞান পরিবার থেকেই পেয়েছেন। ছোটবেলায় পড়তেন স্কুলে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি সেখানেই পড়ালেখা করেছেন। কিন্তু পবিত্র কোরআন ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গভীর টান থাকার কারণে একসময় তিনি স্কুলের পাঠ ছেড়ে চলে আসেন মাদ্রাসায়। এ আসার পেছনে তখনকার সময়ের স্কুলে একটি ইংরেজি বই ‘পপুলার স্টোরি’তে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর জীবনী পাঠ ও স্কুলের মৌলভী স্যারের কোরআন না পড়ুয়া ছাত্রদের বিষয়ে গভীর চিন্তিত হওয়ার প্রভাব কাজ করেছিল। অতঃপর ১৯৭২ সালে দ্বীনি ইলম শিক্ষার উদ্দেশে প্রথমে হোসেনপুরের মাধখলা সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হন। প্রচুর পড়ালেখা করে এক বছরেই সেখানে মিজান জামাতের (ষষ্ঠ শ্রেণি) কিতাব পর্যন্ত পড়ে নেন।
পরের বছর ওস্তাদদের পরামর্শে হজরত আতহার আলী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত ‘জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ’ এসে নাহবেমির (সপ্তম শ্রেণিতে) জামাতে ভর্তি হন। কিন্তু মাদ্রাসাটি স্বাধীনতা উত্তর প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার কারণে পড়ালেখায় ছন্দ হারায়। সে জন্য পরের বছর ওস্তাদদের পরামর্শে উন্নত পড়ালেখার জন্য সিলেটের জামিয়া কাসিমুল উলুম দরগাহে হজরত শাহজালাল (রহ.) বা দরগাহ মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হন। সেখানে হেদায়াতুন্নাহু (অষ্টম শ্রেণি) জামাত পড়েন। অতঃপর প্রিয় শায়খ হজরত আতহার আলী (রহ.) [১৯৭৪-১৯৭৬] ময়মনসিংহের ‘জামিয়া ইসলামিয়া চরপাড়ায়’ থাকাকালে সেখানে আসার জন্য হজরতকে চিঠি লিখেন। সম্মতি পেয়ে সেখানে এসে কাফিয়া জামাতে (নবম শ্রেণি) ভর্তি হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যেদিন তিনি সেখানে ভর্তি হলেন সেদিনই (৬ অক্টোবর, ১৯৭৬ সাল) হজরত আতহার আলী (রহ.) ইন্তেকাল করেন। পরের বছর পুনরায় এসে জামিয়া ইমদাদিয়ায় ভর্তি হন এবং শরহে জামি থেকে দাওরায়ে হাদিস (১০ম শ্রেণি থেকে মাস্টার্স) পর্যন্ত সেখানেই পড়ালেখা করেন। ১৯৮১ সালে দাওরায়ে হাদিস পড়ে সেখান থেকে ফারেগ হন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি অনেক বড় বড় আলেমের কাছে পড়েছেন।
পড়ালেখা শেষে শুরু হয় দ্বীনি খেদমতের জীবন। প্রথমে ময়মনসিংহের বিখ্যাত মাদ্রাসা ‘জামিয়া আশরাফিয়া খাগডহরে’ শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৮১-১৯৮২ সাল সেখানে কাটিয়ে ১৯৮৩ সালে নিজের পড়ালেখা করা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায় শিক্ষকতার ডাক পান। এরপর এখানে এসে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত থাকেন। শুরুতেই বলা হয়েছে, তিনি উম্মাহ দরদি এক আলেম। তাই মাদ্রাসায় খেদমতের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের দ্বীনধর্ম নিয়েও ভাবতেন। কীভাবে গ্রামে গ্রামে মক্তব প্রতিষ্ঠা করা যায়, মাদ্রাসা নির্মাণ করা যায়, মসজিদ বানানো যায়, মানুষকে ধর্মীয় কাজে সম্পৃক্ত করা যায়Ñ সে সব ভাবনা তাকে ডুবিয়ে রাখত সারাক্ষণ চিন্তার সাগরে। অধ্যাপনার ফাঁকে ফাঁকে সেসব বিষয়ে কাজ করতেন। কিন্তু নিজের কাক্সিক্ষত কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে ভেবে পাকিস্তানের করাচির শায়খ হাকীম আখতার (রহ.)-এর অনুমতিক্রমে ১৯৯৮ সালে জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন এবং দ্বীনের উন্মুক্ত ময়দানে কাজ শুরু করেন। তখনকার সময়ে তার ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না। পায়ে হেঁটে, কখনো মোটরসাইকেলে করে, আবার কখনো বাসে-ট্রেনে চড়ে এলাকায় ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দাওয়াতুল হক ও মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজ করতেন। আল্লাহর রহমতে তিনি সফল হয়েছেন।
তার ভাবনা, পিছিয়ে থাকা যেকোনো জনপদকে উন্নয়নের ধারায় নিতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এই বিশ্বাস থেকেই ধর্মীয় শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা এলাকায় তিনি এ পর্যন্ত ৬৫০টিরও অধিক মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তন্মধ্যে কিশোরগঞ্জে অবস্থিত জামিয়া আবু বকর সিদ্দিক (রা.), মাদ্রাসায়ে নুরিয়া বাগে জান্নাত ও আয়শা সিদ্দিকা (রা.) মহিলা মাদ্রাসা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মাদ্রাসায় তিনি বোখারি শরিফের দরসও দিচ্ছেন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কিছু মসজিদ।
তার গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নানাভাবে ছড়াচ্ছে শিক্ষার আলো। তিনি শুধু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেই দায়িত্ব শেষ মনে করেন না। এসব প্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো পড়াশোনা হচ্ছে কিনা সে খবরও রাখেন নিয়মিত। ভালো পড়াশোনার জন্য তাগিদ দেন। শিক্ষক-কর্মচারীদেরে ভালো-মন্দের খোঁজখবরও নেন। ধর্মীয় দায়িত্ববোধ, শিক্ষা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই তিনি এসব কাজ করেন। মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য কিশোরগঞ্জের চর শোলাকিয়ায় নির্মাণ করেছেন- খানকায়ে ইমদাদিয়া আশারাফিয়া। সেখানে প্রতি সপ্তাহ কিংবা মাসে এবং বছরে তিন দিনের বিশেষ জোড় পরিচালিত হয়ে আসছে। কখনো কখনো বার্ষিক জোড় কিশোরগঞ্জের মারিয়া এলাকাতেও করতে দেখা যায়। ভবিষ্যতে শরিয়াহ মোতাবেক চিকিৎসাসেবা দানের লক্ষ্যে ইসলামি হাসপাতাল করারও চিন্তাভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে মারিয়াতে একটি ক্লিনিকের ভবনের কাজও শেষ হয়েছে।
তালিম, তাজকিয়া ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি সময় হলে লেখালেখির কাজও করেন। এ পর্যন্ত তার তত্ত্বাবধানে বেশ কয়েকটি বই অনুবাদ ও লিখিত হয়েছে। তন্মধ্যে তাকওয়ার নুর, আত্মসমালোচনা, পীর-মুরিদির হাকিকত, আল্লাহর দোস্ত হওয়ার উপায় ও আদর্শ মহিলা মাদ্রাসার রূপরেখা বইগুলো পাঠের শীর্ষে রয়েছে। সংসার জীবনে আছে দুই স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে। তাদের কয়েকজন আলেম হয়ে খেদমতে আছেন আর কেউ কেউ অধ্যয়নরত। বড় ছেলে মুফতি আবদুল্লাহ সাদিক জামিয়া আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কিশোরগঞ্জের মুহতামিম ও আয়শা সিদ্দিকা (রা.) মহিলা মাদ্রাসার মুহাদ্দিস পদে অধ্যাপনা করছেন। ৭০ বছরের বয়োবৃদ্ধ এই আলেম বার্ধক্যজনিত বহু রোগ নিয়েও এখনো জাতির দ্বীনধর্মের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ইসলাহি প্রোগ্রাম করে বেড়ান। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমাদের প্রিয় শায়েখ, প্রিয় রাহবারের নেকছায়া আরও প্রলম্বিত হোক। আরও অনেক দিন তিনি আমাদের মাঝে থেকে দ্বীনের খেদমত করুন। আমিন!